হজকারীর ভুলত্রুটি

29
2387

f3aeba0e-a4f3-4d0d-b18c-b2b774635871_16x9_600x338

রচনা : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক | সম্পাদনা : নুমান বিন আবুল বাশার

হজ পালনকালে অনেকেই ভুলত্রুটি করে থাকেন। নীচে উল্লেখযোগ্য কিছু ভুল তুলে ধরা হল।

ক. মীকাত ও এহরাম বিষয়ক ভুল

  • হজ কিংবা উমরার নিয়ত থাকা সত্ত্বেও এহরাম না বেঁধেই মীকাত অতিক্রম করা।
  • এহরামের কাপড় পরিধান করার পর থেকে ইযতিবা করা, ও তাওয়াফ শেষে ইযতিবা অবস্থাতেই দু’রাকাত সালাত আদায় করা। ইযতিবা অর্থ চাদরের দু’প্রান্ত বাম কাঁধের ওপর রেখে দিয়ে ডান কাঁধ উন্মুক্ত রাখা।
  • উমরার নিয়তের সময় اللهم إني أريد العمرة فيسرها لي وتقبلها مني ও হজরে নিয়তের সময় اللهم إني أريد الحج فيسره لي وتقبله منيউচিত নয়। কেননা এ ধরনের কোনো নিয়ত হাদিসে উল্লেখিত হয়নি। উমরার নিয়তের সময় لبيك عمرة ও হজের নিয়তের لبيك حجا বলাই সঠিক।

খ. তালবিয়া পাঠের ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি

  • অনেকে দলবদ্ধভাবে একই স্বরে তালবিয়া পাঠ করে থাকেন। পূর্বে একজন বলেন পরে সবাই সমস্বরে বলেন। এরূপ করা ভুল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবাগণ এভাবে তালবিয়া পাঠ করেননি। তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্নভাবে উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়তেন।
  • অশুদ্ধভাবে তালবিয়া পাঠ। তালবিয়া হজের স্লোগান হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই অশুদ্ধভাবে তালবিয়া পাঠ করেন। এটা ঠিক নয় বরং গুরুত্ব দিয়ে তালবিয়া মুখস্থ করতে হবে ও বিশুদ্ধভাবে পাঠ করতে হবে।

গ. হেরেম শরীফে প্রবেশের সময় ভুলত্রুটি

  • হারাম শরীফে প্রবেশের সময় অনেক হাজি এমন কিছু দোয়া পাঠ করে থাকেন যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়নি। অথচ সংগত হল মাসনুন দোয়া পাঠ করা।
  • মসজিদুল হারামের নির্দিষ্ট একটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করা অনেকেই জরুরি মনে করেন। এটা ঠিক নয়, বরং যে কোনো দরজা দিয়েই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করা চলে।

ঘ. তাওয়াফের সময় ভুলত্রুটি

  • তাওয়াফের প্রত্যেক চক্করের জন্য বিশেষ কোনো দোয়া নির্দিষ্ট করা ও তা পড়া।
  • তাওয়াফের সময় একজন নেতৃত্ব দিয়ে উচ্চ স্বরে দোয়া পড়া ও অন্যরা সমস্বরে তার অনুকরণ করা।
  • অনেকেই মনে করেন হাজরে আসওয়াদ চুম্বন না করলে হজ অশুদ্ধ হবে, এ ধারণা ঠিক নয়। বরং ভিড় না থাকার হালতে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন-স্পর্শ করা সুন্নত। পক্ষান্তরে ভিড়ের সময় কেবল ইশারা করাই সুন্নত।
  • কেউ কেউ রুকনে য়ামেনিকে চুম্বন করে থাকে। এটা শুদ্ধ নয়। বরং সম্ভব হলে কাউকে কষ্ট না দিয়ে ডান হাত দিয়ে রুকনে য়ামেনিকে স্পর্শ করা ও স্পর্শের পর হাতে চুম্বন না করা। স্পর্শ করা সম্ভব না হলে, এ ক্ষেত্রে, হাতে ইশারা করার কোনো বিধান নেই।
  • তাওয়াফের সময় কেউ কেউ কাবার দেয়াল স্পর্শ করেন অথচ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনি ছাড়া আর কিছু স্পর্শ করেনি।
  • তাওয়াফের সময় কেউ কেউ হাতীমের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে থাকে। এরূপ করলে তাওয়াফ হবে না। কেননা হাতীম পবিত্র কাবার অংশ হিসেবে বিবেচিত।
  • অনেক হাজি তাওয়াফের সময় সাত চক্করেই রামল করেন এরূপ করা উচিত নয়। কেননা নিয়ম হল কেবল প্রথম তিন চক্করে রামল করা, আর বাকি চক্করগুলোতে স্বাভাবিকভাবে চলা।
  • তাওয়াফের সময় অনেকেই মাকামে ইব্রাহীমিকে হাত অথবা রুমাল-টুপি দিয়ে স্পর্শ করে থাকে, এরূপ করা মারাত্মক ভুল।
  • বিদায়ি তাওয়াফের পর পবিত্র কাবার সম্মানার্থে উল্টো হেঁটে বের হওয়া সংগত নয়। কেননা এরূপ করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবাদের থেকে বর্ণিত হয়নি।
  • অনেকের ধারণা-মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে ছাড়া মসজিদের অন্য কোথাও তাওয়াফের দু’রাকাত সালাত আদায় করা যাবে না। এ ধারণা সঠিক নয়।

সাঈ করার সময় ভুলত্রুটি

  • সাঈর নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়া।
  • মারওয়া পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করা।
  • সাফা পাহাড়ে উঠে সালাতের তাকবিরের ন্যায় দু’হাত উঠিয়ে ইশারা করা। শুদ্ধ হল দু’হাত তুলে শুধু দোয়া করা।
  • কেউ কেউ মনে করেন, সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফায় ফিরে এলে সাঈর এক চক্কর সম্পূর্ণ হয়। এ ধারণা ভুল। সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত গেলেই বরং এক চক্কর সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
  • সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফা পর্যন্ত সাঈ করার পুরো সময়টাতে দ্রুত চলা ভুল। সাঈর সময় দ্রুত চলতে হবে কেবল সবুজ দুই চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে।
  • কেউ কেউ সাঈ করার সময়ও ইযতিবা করে থাকে। এটা ভুল। ইযতিবা কেবল তাওয়াফে কুদুমের সময় করতে হয়।
  • পুরুষদের জন্য সবুজ চিহ্নের মাঝে সাঈ তথা দৌড়ে না চলা।
  • সাঈর প্রত্যেক চক্করের জন্য আলাদা দোয়া নির্ধারণ করা।

ঙ. হলক কিংবা কসরের সময় ভুলত্রুটি

  • মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করার সময় সম্পূর্ণ মাথা পরিব্যাপ্ত না করা। কেউ কেউ একাধিক উমরা আদায়ের লক্ষ্যে এরূপ করে থাকে যা খেলাফে সুন্নত ও ভুল।
  • সাঈর পর বাসায় গিয়ে স্বাভাবিক কাপড়-চোপড় পরে হলক-কসর করা। অথচ নিয়ম হল এহরামের কাপড় গায়ে থাকা অবস্থায় হলক-কসর করা।

চ. ৮ জিলহজ হাজিদের ভুলত্রুটি

  • ৮ তারিখে মিনাতে না এসে সরাসরি আরাফায় চলে যাওয়া।
  • পুরুষের ক্ষেত্রে উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠ না করা।
  • মিনাতে জায়গা থাকা সত্ত্বেও মিনার বাইরে অবস্থান করা।

ছ. আরাফা দিবসের ভুলত্রুটি

  • আরাফার সীমানায় প্রবেশ না করেই উকুফ করা এবং সূর্যাস্তের পর মুযদালেফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া।
  • আরাফা মনে করে মসজিদে নামিরার সম্মুখ ভাগে উকুফ করা। অথচ এ অংশটি আরাফার সীমানার বাইরে।
  • জাবালে আরাফায়—যাকে লোকেরা জাবালে রহমত বলে—যাওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় মনে করা এবং সেখান থেকে বরকতের আশায় পাথর সংগ্রহ করা।
  • কিবলাকে পেছনে রেখে জাবালে আরাফার দিকে মুখ করে দোয়া করা।
  • সূর্যাস্তের পূর্বেই মুযদালেফার উদ্দেশ্যে আরাফা থেকে বের হয়ে যাওয়া।

জ. উকুফে মুযদালেফার ভুলত্রুটি

  • ধীর-স্থির ও শান্ত ভাব বজায় না রেখে হুলস্থুল করে মুযদালেফার পথে রওয়ানা হওয়া।
  • মুযদালিফায় পৌঁছার পূর্বে পথেই মাগরিব এশা আদায় করে নেয়া। সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির আযকারের মাধ্যমে মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করা। মুযদালিফায় উকুফ না করে তা অতিক্রম করে মিনায় চলে যাওয়া।
  • সূর্যোদয় কিংবা তারও পর পর্যন্ত মুযদালেফার উকুফকে প্রলম্বিত করা। কেননা রাসূল (ﷺ) সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

ঝ. কঙ্কর নিক্ষেপের ভুল-ত্রুটি

মুযদালেফা থেকে কঙ্কর কুড়িয়ে না নিলে কঙ্কর নিক্ষেপ শুদ্ধ হবে না বলে ধারণা করা। জামরাতে শয়তান রয়েছে মনে করে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় উত্তেজিত হয়ে নিক্ষেপ করা। স্তম্ভের গায়ে কঙ্কর না লাগলে কঙ্কর নিক্ষেপ শুদ্ধ হবে না বলে ধারণা করা। বরং হাউজের মধ্যে যেকোনো জায়গায় পড়লেই কঙ্কর নিক্ষেপ শুদ্ধ হবে। মুস্তাহাব মনে করে কঙ্কর ধুয়ে পরিষ্কার করা। নিজে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ভিড়ের ভয়ে অন্যকে দিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করানো। ১১ ও ১২ তারিখে সূর্য ঢলে পড়ার পূর্বে কঙ্কর মারা। প্রতি জামারাতে ৭ টির বেশি কঙ্কর মারা এবং প্রতিদিন দুই কিংবা তিনবার করে কঙ্কর মারা।প্রথম ও মাধ্যম জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর দোয়া করার জন্য না দাঁড়ানো। ৭ টি কঙ্কর একবার মুষ্টিবদ্ধ করে নিক্ষেপ করা।

অন্যান্য ভুলত্রুটি

  • আইয়ামে তাশরীকে মিনায় অবস্থান না করা।
  • হারাম সীমানার বাইরে ‘হাদী’ জবেহ করা। কুরবানির জন্য উপযুক্ত কিনা তা যাচাই না করে কুরবানি করা।
  • কুরবানি করার পর নিজে না খেয়ে এবং ফকির মিসকিনকে না দিয়ে ফেলে দেয়া। ঈদের দিনের আগে কুরবানি করা।
  • কঙ্কর নিক্ষেপের কাজ শেষ করার পূর্বেই বিদায়ি তাওয়াফ সম্পন্ন করা এবং কঙ্কর নিক্ষেপ করে সরাসরি নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাওয়া। বিদায়ি তাওয়াফের পর যাত্রার ব্যস্ততা ব্যতীত বিনা প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা।বিদায়ি তাওয়াফের পর কাবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানানো। কিংবা কাবাকে সামনে রেখে উল্টো হেঁটে মসজিদ থেকে বের হওয়া।

মদিনা মুনাওয়ারা যিয়ারতকালে ভুলত্রুটি

  • মদিনা যিয়ারত হজের অংশ বলে মনে করা।
  • রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কবর যিয়ারতকালে কবরের চারপাশের দেয়াল বা লোহার জানালাগুলো স্পর্শ করা, চুম্বন করা এবং বরকত লাভের উদ্দেশ্যে জানালায় সূতা বা অনুরূপ কিছু বাঁধা।
  • অভাব পূরণের জন্য কিংবা বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য রাসূল (ﷺ) এর কাছে দোয়া করা। কোনো কিছুর জন্য দোয়া কেবল মহান আল্লাহর কাছেই করার বিধান রয়েছে।
  • মসজিদে নববির ভেতর রাসূল (ﷺ) এর মিহরাব ও উসমানী মিহরাবে দু’রাকাত সালাত আদায় করা, ও একে বরকতময় মনে করা।
  • মসজিদে নববির দেয়াল, রাসূল (ﷺ) এর মিহরাব ও মিম্বার বরকতের উদ্দেশে স্পর্শ করা, কিংবা এতে চুম্বন করা।
  • উহুদ পাহাড়ের বিভিন্ন গুহায় যাওয়া এবং তাবারুক লাভের আশায় ছেঁড়া কাপড় বা নেকরা বাঁধা এবং সেখানে এমন-সব কাজ করা যাতে আল্লাহর ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অনুমতি নেই।
  • এ ধারণা পোষণ করে কিছু স্থানের যিয়ারত করা যে, এগুলো রাসূল (ﷺ) এর নিদর্শন। যেমন উষ্ট্রীর বসার স্থান, আংটি কূপ(যে কূপে রাসূল (ﷺ) এর আংটি পড়ে গিয়েছিল) অথবা উসমান (y) এর কূপ। আর বরকত লাভের আশায় এ সমস্ত স্থান হতে মাটি সংগ্রহ করা।
  • রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কবরের পাশে গিয়ে উচ্চস্বরে দোয়া পাঠ করা এবং এ ধারণা করে সেখানে দীর্ঘক্ষণ দোয়া করতে থাকা যে, এ স্থান দোয়া কবুলের বিশেষ স্থান। মসজিদে নববিতে নির্দিষ্ট সংখ্যায় সালাত আদায় ওয়াজিব মনে করা। বাকি কবরস্থান ও উহুদের শহীদদের কবরস্থানে গিয়ে তাদের কবর যিয়ারতকালে কবরে শায়িত ব্যক্তিদের আহবান করা এবং কল্যাণ-বরকত লাভের আশায় যেখানে টাকা পয়সা নিক্ষেপ করা।
  • সাত মসজিদ নামক স্থানে গিয়ে ফজিলত লাভের উদ্দেশে প্রত্যেকটি মসজিদে দু’রাকাত করে সালাত আদায় করা। মদিনায় থাকাকালীন সময়ে খালি পায়ে চলা এ বিশ্বাসে যে মদিনায় জুতা পরিধান করা উচিত নয়।
Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

29 COMMENTS

  1. apnader Hajj related post gulu aro at least 1 month agey dewa uchit silo. tailey ebar er onek hujjaj er thekey benefited hotey parten.

  2. কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হাজ্জ  ও উমরাহ পালনে সহযোগিতা করে এমন হাজ্জ এজেনসী এর নাম দিতে পারবেন প্লিজ?

  3. বাংলাদেশে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হাজ্জ  ও উমরাহ পালনে সহযোগিতা করে এমন হাজ্জ এজেনসী এর নাম দিতে পারবেন প্লিজ?

  4. আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ,
    বাংলাদেশে কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হাজ্জ  ও উমরাহ পালনে সহযোগিতা করে এমন হাজ্জ এজেনসী এর নাম দিতে পারবেন প্লিজ?
    জাযাক আল্লাহু খায়ের …

আপনার মন্তব্য লিখুন