ইসলামে স্বাধীনতা

0
1920

লিখেছেনঃ কাউসার বিন খালেদ । ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবন গাফফার

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

শরীয়ত অনুমোদিত স্বাধীনতা

স্বাধীনতা সুন্দর-শোভাময় ; আল্লাহ্‌ তা’আলা এই স্বাধীনতার স্বভাবগুণে ভূষিত করেই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে ইসলাম যে-সকল হক প্রদান করেছেন, স্বাধীনতা তার মধ্যে অন্যতম। তা, বরং, আবশ্যক সমাজের প্রতিটি সদস্যের জন্য, যেমন আবশ্যক হৃদপিন্ডের জন্য নির্মল বাতাস, এবং দেহের জন্য আত্মা। স্বাধীনতা হচ্ছে প্রতিটি মানুষের, সমাজের প্রতিটি সদস্যের কাক্সিক্ষত ও অভীষ্ট লক্ষ্য ; এ এমন এক মৌল নীতি, যার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান এবং যাকে গুরুত্ব দানের ক্ষেত্রে তাবৎ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এক কথায় উদগ্রীব। রাষ্ট্র অথবা সরকার স্বাধীনতার প্রতি যতটা গুরুত্ব দেবে, স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রতি যতটা তাগিদ করবে, জনমানসে ঠিক ততটাই সে সম্মানের স্থানে ভূষিত হবে। ইসলাম ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা, তাকে অনর্থের কোপানল হতে রক্ষার বৃহৎ এজেন্ডা নিয়ে আগমন করেছে,—হোক তা ধর্মীয়, চিন্তানৈতিক কিংবা পলিটিক্যাল স্বাধীনতা, অথবা কর্তব্যকর্ম ও ব্যায়ের স্বাধীনতার যে ধারণা ও শ্রেণী প্রচলিত, সে সংক্রান্ত স্বাধীনতা।

ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করেছে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি, এবং এর জন্য প্রণয়ন করেছে সুস্পষ্ট নীতিমালা। ঘোষণা করেছে—ইসলাম গ্রহণের নিমিত্তে কাউকে স্বীয় ধর্ম পরিত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। ইসলাম, বরং, মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে আলোচনার মৌল বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে ইসলামের প্রতি দাওয়াত, তার সৌন্দর্য ও মাহাত্ম উপস্থাপন এবং বর্ণনা—ইত্যাদিকে।

আল্লাহ্‌ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: দীন সম্পর্কে কোন জোর-জবরদস্তি নেই, সত্য ভ্রান্তি হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। [সূরা বাকারা: ২৫৬]

অপর এক আয়াতে আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন: আপনি আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও শোভনীয় উপদেশের মাধ্যমে, এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম উপায়ে। [ সূরা নাহল, আয়াত ১২৫]

ইসলাম, ধর্মীয় স্বাধীনতার পাশাপাশি, মুসলিম ও অমুসলিমের আচরণ নীতিমালাও বর্ণনা করে দিয়েছে, এবং ঘোষণা করেছে—অপরাপর ধর্মের অনুসারীদের ধর্মচর্চা তাদের মৌলিক অধিকার, সুতরাং তাদের ধর্মোপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না, তাদের ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে আরোপ করা যাবে না ন্যূনতম বিঘ্নতা। বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে, তাই, তাদেরকে দেয়া হয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা ; যা তাদের ধর্মানুসারে বিধিসম্মত, তারা তা-ই পালন করবে। বৌদ্ধিক ও যৌক্তিক নীতিমালা অনুসারে তাদের সম্মান ও স্বার্থ রক্ষাই হল ইসলামের নীতি।

আল্লাহ্‌ পাক কোরআনে এরশাদ করেন: তারা যদি তোমার নিকট আগমন করে, তবে তুমি তাদের মাঝে বিচার-ফয়সালা করো, কিংবা তাদের হতে মুখ ফিরিয়ে নাও। [ সূরা মায়িদা: ৪২]

অর্থাৎ, বিচারটি তাদের বিধানের উপর ছেড়ে দেন। নবী [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] বলেন: যে ব্যক্তি কোন জিম্মিকে কষ্ট দিবে, আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। আবু দাউদ ও বাইহাকীর বর্ণনায় এসেছে—যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধকে নিপীড়ন করবে, তার ক্ষতিসাধন করবে, কিংবা সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে, অথবা তার থেকে অনিচ্ছায় কোন কিছু কেড়ে নেবে, কেয়ামত দিবসে আমি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। [ আবু দাউদ: হাদীস নং ২৬৫৪]

অমুসলিমদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সাধারণ নীতিমালা হচ্ছে : অধিকার প্রাপ্তি ও অধিকার বঞ্চনার ক্ষেত্রে সমতা। আমরা যা পাব, তারাও তা পাবে, এবং যা হতে বঞ্চিত হব, বঞ্চিত হবে তারাও। তবে, তারা যদি প্রতারণার আশ্রয় নেয়, কিংবা ভঙ্গ করে চুক্তি, তবে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তাদেরকে।

ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতার অনুরূপ স্বাধীনতা দিয়েছে চিন্তা ও অভিব্যক্তির। অর্থাৎ, মানুষ একটি সুন্দর পরিণতি ও ফলাফলে উপনীত হওয়া অবধি তার চিন্তাকে কাজে লাগাবে। ইমান ও ইয়াকিনের সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হওয়ার তাগিদে চিন্তার এই ব্যবহারের প্রতি নির্দেশ এবং উৎসাহ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ্‌ তাআলা। তাই, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে চিন্তার ব্যবহার এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফলে বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিশীলতায় বৌদ্ধিক মুক্তি নিশ্চিত করণের প্রতি তিনি আহ্বান করেছেন।

আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: তারা কি লক্ষ্য করে না আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম কর্তৃত্ব সম্পর্কে এবং আল্লাহ্‌ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার সম্পর্কে ?  [সূরা আরাফ, আয়াত ১৮৫]

ইসলামের এই চিন্তানৈতিক স্বাধীনতা এবং এর সফল অনুবর্তনের অবশ্যম্ভাবী ফল হচ্ছে ইসলামের কালচারাল, চিন্তা, জ্ঞান এবং শাস্ত্রীয় এ বিপুল ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক পরম্পরা, মুসলিমগণ উত্তরাধিকার সূত্রে যুগপৎ যা বহন করে আসছে। রাসূল হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি তার সাহাবাদের থেকে সত্য বলা, এবং তার দ্ব্যর্থহীন প্রকাশের প্রতিশ্র“তি নিয়েছিলেন। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন যে, উপদেশকে তারা প্রাধান্য দেবেন এবং আল্লাহ্‌র পথে ভয় করনেব না কোন ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনাকে।

উবাদা বিন সামেত হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: সহজ এবং কঠিন—উভয় অবস্থায় আনুগত্যের ব্যাপারে রাসূল আমাদের হতে প্রতিশ্র“তি নিয়েছিলেন। আমরা প্রতিশ্রতিবদ্ধ হয়েছিলাম যে, যেখানেই থাকি না কেন, আমরা সত্য বলব, আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রে কোন র্ভৎসনাকারীর ভর্ৎসনাকে ভয় করব না। [ বুখারি : ৬৬৬০]

বরং, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান, সত্যের দ্ব্যর্থহীন প্রকাশ, এবং কল্যাণের প্রতি আহ্বান—সন্দেহ নেই, এমন কিছু চিন্তানৈতিক টার্ম, অন্যান্য ধর্ম এবং মতাদর্শ হতে ইসলামকে যা বিশেষ বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করেছে। মুক্ত পলিটিক্স চর্চা এবং পলিটিক্যাল স্বাধীনতা, পক্ষান্তরে, ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিধিসম্মত পন্থায় ক্ষমতায় অংশগ্রহণ, শাসকবর্গ ও আমলা শ্রেণীর নজরদারী এবং সুস্থ পন্থায় তাদের সমালোচনা এবং ফলত: তাদেরকে সঠিক লক্ষ্যে নিপতিত করার বিষয়টি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর প্রদত্ত খুতবা হতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়: ‘হে লোকসকল ! আমি তোমাদের শাসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি, আমি তোমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি নই ; আমি যদি ভাল করি, তবে তোমরা আমায় সহযোগিতা কর। যদি ভুল করি, তবে আমাকে শুধরে দিও। আমি তোমাদের ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্‌র আনুগত্য করব, তোমরাও আমার আনুগত্য করবে। আর যদি অবাধ্য হই, তবে তোমাদের দায়িত্ব নয় আমার আনুগত্য করা।’ বর্ণিত আছে, জনৈক ব্যক্তি উমর বিন খাত্তাব রা.-কে লক্ষ্য করে বলল, হে আমীরুল মোমিনীন ! আল্লাহ্‌কে ভয় করুন ! এ সময় অপর এক ব্যক্তি তাকে বাধা দিল। তার কাছে কাজটি গর্হিত বলে মনে হল। উমর বললেন, তাকে বলতে দাও। তোমরা যদি এরূপ না বল, তবে তোমাদের মাঝে কোন কল্যাণ থাকবে না। আর আমরা যদি তা শ্রবণ না করি, তবে আমাদের মাঝেও কোন কল্যাণ থাকবে না।

এই হচ্ছে ইসলামের বিধিসম্মত স্বাধীনতা।

পক্ষান্তরে, কর্ম ও তৎপরতার যে স্বাধীনতা—সন্দেহ নেই, এ ক্ষেত্রে রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা; শর্ত হচ্ছে আল্লাহ্‌ তা’আলার বেধে দেয়া বৈধ নীতিমালার অনুবর্তন যা বয়ে আনবে সমাজের উন্নতি, কল্যাণ ও সাফল্য ।

আল্লাহ্‌ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন: তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা তার দিগ-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর, এবং তারই পানে তোমরা পূনরুত্থিত হবে।  [সূরা মুলক, আয়াত ১৫]

হাদিসে এসেছে: মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে তোমাদের কেউ যদি রশি নিয়ে লাকড়ি কুড়ায় তা হবে অনেক উত্তম।

ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতার এ হচ্ছে কিছু খন্ড চিত্র, ইসলাম যা প্রনয়ণ করেছে মানব কল্যাণে। অপরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কোনভাবেই বৈধ হতে পারে না। তবে, যদি সমাজ এবং তার সাধারণ নীতিমালা ও মূল্যবোধের জন্য কেউ হুমকি হয়ে উঠে, তবে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বৈধ।

ব্যক্তি স্বাধীনতার লাগামহীন চর্চাকারীর জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উদাহরণ টেনে সতর্ক করেছেন এভাবে— আল্লাহ্‌র সীমারেখায় জীবনযাপনকারী এবং তা লঙ্ঘনকারীর দশা হচ্ছে সেই জাতির মত, যারা একটি জাহাজের স্থান বন্টনের জন্য লটারীর আশ্রয় নিল। কেউ উপরে স্থান পেল, কেউ পেল নিচে। যারা নিচে পেল, তাদের পানির চাহিদা হলে উপরের লোকদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হত। অতঃপর তারা বলল, আমরা যদি আমাদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই, যারা আমাদের উপরে অবস্থান করছে, তাদের কষ্ট না দিই তবে কি ভাল হয় না ? উপরের লোকেরা যদি তাদেরকে এ কাজটি করতে দেয়, তবে সকলে ধ্বংস হবে, আর যদি বাধা প্রদান করে, তবে সকলে রক্ষা পাবে।

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন