খাদ্য অপচয়

0
3476

লেখক: শরীফ আবু হায়াত অপু

২০০৫ সালের কথা। দীপালিদের বাসায় নিয়ম ছিল যে সে খাবে রাতের ভাত, আর দুপুরে খাবে তারভাই। এই নিয়মের পিছনে জিরো ফিগারের বাসনা না – ছিল তার বাবার চাল কেনারঅক্ষমতা। একদিন সন্ধ্যায় দীপালীর ভাই এমনই ক্ষুধার্ত ছিল যে সে তার বোনেররাতের ভাগটুকু খেয়ে নেয়। প্রায় ২৪ ঘন্টার অভুক্ত দীপালি যখন দেখে তারভাত তার আপন ভাই চুরি করেছে তখন অভিমানে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আরকোনদিন যেন বাবা-মার কাছে ভাত না চাইতে হয়, তাই সে কন্ঠে কাপড় জড়িয়েঝুলে পড়ে। জীবনের মত সে তার ভাগের ভাতটা ভাইকে দিয়ে যায়।

আমরা জানি আত্মহত্যা মহাপাপ। তবে আমরা এটা জানিনা যে আজ রাতে আমাদের হাঁড়িধোয়ার সময় যে ভাতগুলো ফেলে দেয়া হবে তাতে দীপালির ভাগ ছিল। যতই জনসংখ্যাবাড়ুক, এই দুনিয়াতে আল্লাহ যত মুখ সৃষ্টি করেছেন তাদের সবার খাবারেরভাগও তিনি রেখেছেন। যখন কেউ কারো মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় তখন মানুষঅনাহারে আত্মহত্যা করে। গরীব মানুষের মুখের গ্রাস শুধু মাল্টি ন্যাশনালকোম্পানিগুলো একা কেড়ে নেয়না, আমরাও নেই।

রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন তোমরা বেশী খেওনা। যদি খাও তবে অপর ভাইয়ের ভাগ খেয়ে ফেলতে পার। আমরা শুধুই যে বেশী খাই তা নয়, বেশী খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে উচ্ছিষ্টাংশটি ডাস্টবিনের কুকুরদের সমর্পণ করি। চারপেয়ে এবং দু’পেয়ে কুকুর। বাংলাদেশে বিয়ে বাড়িতে মোচ্ছব চলেপ্লেট ভর্তি করার। পিজা হাট অফার দেয় – এস কত খেতে পার। সিয়াম মানে সংযমকে বলেছে? সিয়াম মানে রাক্ষসের মত খাওয়া, যত বেশী খাওয়া যাবে ততই লাভ। সারা বছরে মাত্র একবার পিজা হাট ইসলামের শিক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখায় – সেটা রমাদান মাসে। সিয়াম মানে সংযম কে বলেছে? যিনি দশ পদের কমে ইফতার করেননা তিনি? আমেরিকায় দেখেছি মসজিদ মসজিদে মুফতে ইফতার দেয়। মানুষ ডিসপোজ্যাবল প্লেট ভরে খাবার নেয়, কিছুটা খায়, কিছুটা ছড়ায় তারপরে প্লেট ভাজ করে ট্র্যাশে ফেলে দেয়। বিরিয়ানি ভর্তি প্লেট। রুটি-মাংশ ভর্তি প্লেট। নাশপাতি-আঙুর-খেজুর ভর্তি প্লেট। বাবা-ছেলে পাশাপাশি বসে একই কাজ করে। ফেলেদেয়ার আগে একটুও হাত কাঁপেনা। মাথায় একটুও আসেনা যে সোমালিয়াতে সেইমূহুর্তে মানুষ ইফতার করছে শুধু বাতাস দিয়ে। সৌদি আলিমদের কাছে ফতোয়াজানতে চাচ্ছে – তাদের সেহরিতে খাবার কিছু নেই, ইফতারেও কিছু জোটেনা; তাদেররোজা হবে তো? সৌদি মুফতি উত্তর দিতে পারেননি, ঝরঝর করে কেঁদেছেন। আমরা কেউ প্রশ্নটা শুনতে পাইনি। আমরা তখন খেতে ব্যস্ত ছিলাম।

পৃথিবী কত বদলে যায়। এইতো বছর পঞ্চাশেক আগেও সোমালিয়াকে বলা হত আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি। সেই সবুজ আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে গরু-ছাগলের পাল। মানুষের পাল এখন খোঁয়ারে থাকে। আইএমএফ দয়া আর মমতার বাঁধনে বেঁধে রেখেছে ওদের। ভালবেসে ঋণ দিয়েছে। তারপর বাতলে দিয়েছে ঋণ শোধের উপায়। এই বাঁধনকি আর ছেড়া যায়? বিজ্ঞানীরা বলবেন ক্লাইমেট চেঞ্জ – জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই নাকি এ দুর্ভিক্ষ। পশ্চিমা মিডিয়া বলবে আল-শাবাব মুসলিম চরমপন্থীদের জন্যই আজ এই দশা। খিলাফাতওয়ালারা বলবে তাগুতের তাবেদার সরকারের দোষ। আমি কিছু বলবনা। আমার চোখে ভাসতে থাকবে বিশাল সব ট্র্যাশব্যাগ। কালো কালো ট্র্যাশব্যাগ। একটা ব্যাগে যে পরিমাণ খাবার ফেলে দেয়া হয়েছে তাতে একটা গ্রামের সবগুলো ক্ষুধার্ত মানুষ পেটপুরে খেতে পারত।

শস্য-শ্যামলা-সুজলা বাংলাদেশে এখন জল নেই। আমনের মৌসুমে যেখানে খেত জলে থই থই করে সেখানে এখনপাম্প বসিয়ে সেচ দিতে হয়। ডীপ টিউবওয়েল। পানির স্তর নেমে গেছে বহু দূর, আশি ফুট গভীরতাতেও কাজ চলে না। আমেরিকায় চলছে পঞ্চাশ বছরের সবচে ভয়াবহ খরা। তবু আমাদের বুক কাঁপেনা। ভাবখানা এমন যেন আল্লাহর সাথে পানিচুক্তি করাআছে। অথচ আল্লাহ বলছেন নেই। মহান আল্লাহ হুমকি দিলেন সুরা মুলকের শেষে – তিনি যদি পানির স্তর নামিয়ে নেন তাহলে ভূ-পৃষ্ঠে কে দেবে পানি?

আমরা এই হুমকির থোড়াই কেয়ার করি। আল্লাহ আল কুরআনের দুই জায়গাতে বলেছেন, তোমরা অপচয় করোনা, আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালবাসেননা। আমরা আল্লাহর ভালোবাসার থোড়াই কেয়ার করি। নানান জাতের ভালোবাসাতে ভর্তি হয়ে আছে টিভি। আল্লাহর ভালোবাসা না দেখা যায়, না বেচাযায়। এ ভালোবাসা দিয়ে কি করব?

রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “কারো কাছ থেকে মাটিতে খাবার পড়ে গেলে সে যেন সেটা তুলে, ধুলোটা ঝেড়ে খেয়ে ফেলে; শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। তিনি খাবার পরে হাত চেটে খেতে বলেছেন, কারণ খাবারের কোন অংশে বারাকাত আছে সেটা মানুষ জানেনা।[1] আমাদের যে টেবিল ভদ্রতা শেখান হয় তাতে পতিত খাবার অচ্ছুত ময়লা, তুলে খাওয়া তো দূরে থাক সেটা স্পর্শই করা যাবেনা। কাজের মানুষেরা পরে ঝাড়ু দিয়ে সেটা ফেলে দেবে। হাতের আঙুল বা থালা মুছে খাওয়াতো নিতান্ত অসৌজন্যতা। ইহুদিরা জেরুজালেমে মুসলিমদের হারিয়ে দিয়েছে বলেআমরা হায় হায় করি। আর এদিকে আমরা নিজেরা নিজেদের ডাইনিং টেবলে ইসলামকে হারিয়ে দিয়েছি। শয়তান এখন আর আমাদের শত্রু না – বন্ধু। তাকে আসন পেতেদেই খেতে। পেট ভরার পরে বাকি খাবারটা তার জন্য বরাদ্দ করে রাখি। আর বারাকাত দিয়ে আমরা কি করব? বারাকাত কমছে বলেই খাবারে বিষ দেয়া হচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে খাবারের দাম বাড়ছে, খাবারের স্বাদ-তৃপ্তি সব উধাও হয়ে যাচ্ছে। আপন হাতে কল্যাণের দরজা বন্ধ করে রেখে অন্যকে দুষে কি লাভ?

ইসলামের কথা বাদ দেই, খাবার নষ্ট মানে তো কৃষককে অপমান করা। তার শ্রম, তারকষ্টটাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। আমরা শহুরে মানুষ; একগোছা ধান ফলাতে কি কষ্টআমরা কি করে বুঝব? আমাদের কাছে পাতে ফেলে রাখা এক মুঠ ভাতের দাম কয়েকপয়সা মাত্র – এর চেয়ে বেশী কিছু তো নয়। রান্না করা খাবার ফেলে দেয়া মানে সেই মানুষটার প্রতি অশ্রদ্ধা যে কষ্ট করে খাবারটা রান্না করল চুলার আঁচ সহ্য করে। সেই মানুষটার প্রতি অসম্মান যে কষ্ট করে খাবারটা বয়ে নিয়ে আসল বাজার থেকে। আমরা বুদ্ধিজীবি মানুষ। কাজের মানুষদের সময় আর শ্রম কিনে নিয়েছি কয়েক টাকায়। টাকা দিয়ে সব কিছু শোধ করা যায়না – এটা আমরা বুঝতে চাইনা।

পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ ছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মদিনাতে হিজরত করার পরথেকে তারমৃত্যু অবধি তার পরিবার পরপর তিনদিন পেটপুরে খেতে পারেনি।[2] সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মানুষদের এমন সময়ের মধ্যে যেতে হয়েছে যখন হাবালা গাছের পাতা ছাড়া তাদের আর কোন খাবার ছিলনা। তাদের মল আর ভেড়ার মলের কোন পার্থক্য ছিলনা।৩ আমাদের আল্লাহ খাবারের যে প্রাচুর্য দিয়েছেন সেটাকে আল্লাহর নিয়ামাত বলে আমরা ভাবতে ভালবাসি; ভুলেও চিন্তা করিনা এটা আল্লাহর পরীক্ষাও বটে। আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে খাবার নষ্টের মাধ্যমে আল্লাহর অকৃতজ্ঞতা করছি। শাস্তি হিসেবে ক্ষুধাকে চেয়ে নিচ্ছি।

ভাই, আপনি যদি কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে এরপর যখন আপনি থালায় একটিও ভাত রেখে উঠে যাবেন তখন মনে রেখেন – ইন্নাহু লাইয়ুহিব্বুল মুসরিফিন – নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালবাসেননা। বোন, আপনি যখন আপনার সন্তানের উচ্ছিষ্ট খাবারটি ফেলে দিচ্ছেন তখন মনে রেখেন – ইন্নাহুলা ইয়ুহিব্বুল মুসরিফিন। বেগুনের এক কোণে একটু দাগ থাকার কারণে যখনপুরোটা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন তখন মনে রেখেন – ইন্নাহু লা ইয়ুহিব্বুল মুসরিফিন।

পৃথিবীর মানুষের ভালবাসা না পেলেও জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়; পৃথিবীর রব্ব আল্লাহর ভালবাসা না পেলে ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ যেন আমাদের মুসরিফিন হবার হাত থেকে রক্ষা করেন। খাবারনষ্ট করা যাবেনা এটা যেন আল্লাহ আমাদের মননে-জীবনে গেঁথে দেন।

২৫শে শাওয়াল, ১৪৩৩ হিজরি।

—————————————————–

[1] সহীহ মুসলিম অধ্যায় ২৩ হাদিস ৫০৪৪
[2] সহীহ বুখারি অধ্যায় ৬৫ হাদিস ৩২৭

Print Friendly, PDF & Email
Banner Ad


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন